ব্রয়লারের ফিড তথা মাংসে ক্রোমিয়াম নিয়ে অপপ্রচারের বৈজ্ঞানিক জবাব। (ট্যানারি বর্জ্য ইস্যু)
ক্রোমিয়াম নামা
#এক
আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি মাংস আসলে একটা ফ্যামিলির জন্য Improved meal (Not feast).
মধ্যবিত্তদের প্রতি শুক্রবার মাংশ অবশ্যই থাকতো। গরীবেরা হয়তো খেতেন কালেভদ্রে। তাই বাড়িতে গরীব-এতিমদের খাওয়ানো হলে বড় মুরগি জবাই হতো৷ গরীব লোকেরা কবজি ডুবিয়ে খুশিমনে খেতেন আর দোয়া করতেন এবং সেটাও মন থেকেই (দাওয়াতের উদ্দেশ্য ও সেটাই ছিলো বা আছে)।এখন বিজ্ঞানের অবদানের কারণে ব্রয়লার নামক এক জাত এসেছে যার কারণে মানুষ খুব সহজেই মুরগি কিনতে পারে৷ আমাদের গ্রামে যে লোকাল সিএনজি চালায় সেও তার চৌমুহনী থেকে মোগলেরহাট এর একটা আপ ডাউন ট্রিপের টাকায় সহজেই দেড় কেজির একটা মুরগি কিনতে পারে৷ তাই এখন মাংশ খাওয়া কোনো উপলক্ষ বা দাওয়াত বা দোয়ার সাথে সম্পর্কিত না। মুরগির মাংশ এখন সকালের নাস্তায় তেহারিতে বা মধ্য সকালের Brunch এর স্যান্ডউইচের মাঝে বা বিকালে চিকেন চাপ, সাসলিক এ জায়গা করে নিয়েছে। মধ্যাহ্ন আর রাত্তিরের ভোজনের কথা তো বলাই বাহুল্য।
#দুই
কিন্তু সমস্যা টা হয়েছে আমাদের। এই পুস্টি সম্বলিত মুরগি খেয়ে আমাদের মাথা হয়েছে নস্ট৷ আমরা এখন ব্যবসা বা গবেষণা করি কিন্তু লাভের জায়গায় উলটো মানুষের ক্ষতি করি৷ সম্প্রতি অনেকে যখন এরকম নোংরামি তে যুক্ত হলো তখন আর চুপ থাকাটা সমীচীন মনে হলোনা।
ব্যবসার মূল বিষয় হলো আপনার পণ্য সেরা ভালো সব বলা যাবে৷ কিন্তু অন্যের পণ্য খারাপ সেটা বলা বিজনেসের এথিক্স এই নাই৷
আবার, যদি ঢালাও ভাবে বলেন অন্য সবার পণ্যে সমস্যা যেটা আপনি প্রমাণই করেননি তাহলে তো মিথ্যা বলার ও অপবাদ দেবার দোষে জর্জরিত হতে পারেন।
#তিন
সমস্যাটার সৃস্টি আসলে ক্রোমিয়াম নিয়ে। ক্রোমিয়াম একটি ধাতু যা এককালে নতুন জামাইদের ঘড়ির চকচকা ভাব আনতেই ব্যবহৃত হতো। কিন্তু অনেক নন ভেট, নন হাজবেন্ড্রির লোকদের ধারণা মুরগিকে ক্রোমিয়াম খাইয়ে বড় করে। ধারণা টা ভুল নাকি ঠিক তা দেখি।
#চার
টক্সিকোলজি বা বিষবিদ্যার ভাষায় একটা টার্ম আছে। LD50 বা লিথাল ডোজ ৫০। এটার মানে হলো 'কোন বস্তুর ঐ পরিমাণ দ্রব্য যা কোনোভাবে গৃহীত হলে একটি নির্দিস্ট প্রজাতির ৫০% একটি নির্দিস্ট সময়ের ভেতর মারা যাবে।" সংজ্ঞা টা কঠিন। উদাহরণ দিলে সহজ হবে আশা করি। ধরুন ডায়াবেটিক মানুষের ক্ষেত্রে রসমালাই এর LD50 হলো ১কেজি।
এর মানে হলো ১০০ জন ডায়াবেটিক রোগীর প্রত্যেককে ১ কেজি করে রসমালাই খাওয়ানো হলে ৫০ জন মারা যাবেই।
এখন আসা যাক ক্রোমিয়াম এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কেমন।
ক্রোমিয়াম সাধারণত দুই ধরনের৷ ক্রোমিয়াম-৬ যা সাধারণত ইন্ডাস্ট্রি তে ব্যবহার হয় আর ক্রোমিয়াম-৩ যা সাধারণত এমনেই খাবারে পাওয়া যায় এবং দৈহিক বিভিন্ন বিক্রিয়ায় কাজে লাগে। তাই আমাদের আলোচনার মূল বিষয় শুধুমাত্র ক্রোমিয়াম-৬।
#পাঁচ
প্রথমে আসা যাক মুরগির ক্ষেত্রে এই ক্রোমিয়াম-৬ এর LD50 কত। মুরগির ক্ষেত্রে এর মান হলো ২৭৮ মিলিগ্রাম/কেজি (Kumari et al 2013)।
তার মানে একটি দেড় কেজির মুরগিকে মারতে আনুমানিক ৪১৭ মিলিগ্রাম ক্রোমিয়াম -৬ খাওয়াতে হবে।
ধরলাম ক্রোমিয়াম-৬ খাওয়ালাম ৪০০ মিলি গ্রাম। তাহলে তো আশা করি মুরগিটা বাঁচবে৷
আচ্ছা এই মুরগি মানুষকে যদি খাওয়াই তাহলে কী হবে?
মানুষের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হিসাব মানে LD50 এর অত ভালো হিসাব নেই৷ তবে WHO এর তথ্য মতে ন্যুনতম ২০ মিলিগ্রাম/কেজি ওজন এর উপরে ক্রোমিয়াম-৬ ঢুকলে শরীরে সমস্যার সৃস্টির সম্ভাবনা আছে। (Achmad et al 2017).
তার মানে দাঁড়ায়, একজন ৫০ কেজি ওজনের মানুষ এর জন্য ৫০*২০= ১০০০মিলি গ্রাম বা এক গ্রাম ক্রোমিয়াম খেতে হবে৷ তাহলে তার কিডনির লিভারের বা অন্যান্য সমস্যার সৃস্টি হতে পারে৷
এই ১০০০ মিলি গ্রাম ক্রোমিয়াম-৬ থাকতে পারবে তার মানে ৩.৬ কেজি মুরগিতে (ঐকিক নিয়ম)।
মানে ৫০ কেজির একজন মানুষকে সর্বোচ্চ পরিমাণ ক্রোমিয়াম সমৃদ্ধ ৩ কেজি মুরগির মাংশ দৈনিক খেতে হবে।
কে খান হাত তুলেন দেখি
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মুরগি খায় পাবলিক ভার্সিটির ছেলেপিলে। আল্লাহর দেয়া ৩৬৫ দিনের ৩০০ বেলাতেই আমাদেরকে মুরগি খেতে হতো। বাকী ৬৫ দিন ছুটি। আমাদের তো এতদিনে মরে গিয়ে এনাটমি ল্যাবের স্কেলিটন হয়ে যাবার কথা।
#ছয়
এবার আসেন এই ক্রোমিয়াম-৬ এর আসল সোর্স কী? মুরগিতে এই ক্রোমিয়াম-৬ আসার একটা বড় উৎস হলো খাবার। আর খাবার মানে তাও ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোনো খাবার। এই ক্ষেত্রে আংগুল তোলার একমাত্র জায়গা আছে ট্যানারির দিকে৷
ট্যানারিতে ক্রোমিয়াম-৬ ব্যবহার হয়। আর এই ক্রোমিয়াম ট্রিট করা চামড়ার যেসব শেভিংস গুলো তা পোল্ট্রি খাদ্যে ব্যবহার হবার সম্ভাবনা আছে।
সেক্ষেত্রে গবেষণা কী বলে দেখি।
বাংলাদেশে এই ট্যানারি বর্জ্য আর পোল্ট্রি ফিড নিয়ে দুইটা টিমের গবেষণা আছে। একটা হলো Ahmed et al 2017 ও আরেকটা হলো প্রখ্যাত কুখ্যাত Hossain and Hasan 2014.
আহমেদ সাহেবের গ্রুপ ১২ টা ফিড কোম্পানির প্রোডাক্ট টেস্ট করে পেয়েছেন প্রতি কেজি ফিডে ক্রোমিয়াম এর পরিমাণ ০.০৩ মিলিগ্রামের নিচে। তারা আবার কিন্তু বলেননি এটা ক্রোমিয়াম-৩ নাকি ৬। তাহলে ১০০০ মিলিগ্রাম হতে কত দেরী পাঞ্জেরী???
আবার মিস্টার আবুল হোসেন সাহবের টিম আরেকটু সরেস৷ তারা ফিড কোম্পানিগুলোর 'ব্যান্ড বাজাতে গিয়ে' দেখেন সেখানে ক্রোমিয়ামের পরিমাণ ডিটেকশন লিমিটের ও নিচে। মানে মেশিনে ক্রোমিয়াম এর উপস্থিতিই নিশ্চিত করতে পারেনি।
তাই তারা তাদের পরীক্ষার জন্য মুরগিকে ট্যানারি শেভিংস দিয়ে খাওয়ালেন।
এত হ্যাঁচকাইয়া ক্রোমিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ালেন যে একটা মুরগি ১৬ দিনে আরেকটা ২৪ দিনে অক্কা পেলো।
মানুষ কী মুরগি অক্কা পাবার জন্য ফার্মিং করে??
#সাত
অতএব, ক্রোমিয়াম নিয়ে এত লাফালাফি না করে মুরগি খান। মুরগির বাজার এখন খারাপ শুধুমাত্র গুটিকয়েক চাপাবাজ ও লোভাতুর ব্যবসায়ীর কারণে৷ এই ব্রয়লার যদি বন্ধ হয় তাহলে আমাদেরকে বাইরে হতে কিনে খেতে হবে। এবং প্রতিবেশীরা বসে আছে এটার জন্য। আমার তো মনে হয় ব্রয়লারের বিরুদ্ধে এই যে একটা অপচেস্টা তা বিদেশী শক্তির একটা ষড়যন্ত্র।
#আট
প্রশ্ন উঠতে পারে আমি কেন এসব লেখি। বা অন্য জিনিস নিয়ে কেন লেখিনা।
কারণ, আমি দেখেছি গরীব দুঃখী ছেলেরা, তরুণরা এই খামার করেই আজকে স্বাবলম্বী।
কার্টেসিঃ
ডা. মোঃ রিদুয়ান পাশা, ডিভিএম ও এম এস (সিভাসু)
প্রভাষক
ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়
No comments