Header Ads

Header ADS

ব্রয়লার খেলে মানুষের ডায়াবেটিস হবে---এই কুযুক্তির বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক জবাব। (প্রফেসর আবুল হোসেনের চিনির পানি ইস্যু)

 #ব্রয়লারে_চিনির_পানি_বনাম_মানুষের_ডায়াবেটিস

ঢাবি'র রসায়নের জনৈক প্রফেসর বলেছেন চিনির পানি ব্রয়লারকে খাওয়ানোর কারণে সুগার ডিপোজিশন হয় ব্রয়লারে এবং সেই ব্রয়লার মানুষ খেলে মানুষের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। বিষয়টির বাস্তবিকতা ও সায়েন্টিফিক বিশ্লেষণ করলেই সবার জন্য সত্য অনুধাবন সম্ভব হবে আশা করি।
বাস্তবিকতা হলো ব্রয়লারকে মাঝে মাঝে চিনি,গুঁড় এবং গ্লুকোজ খাওয়ানো হয় ইনস্ট্যান্ট এনার্জি সাপ্লাই এর জন্য। বিশেষ করে ট্রান্সপোর্ট ধকল থেকে শুরু করে যেকোন ধকল ও ভাইরাল রোগে আক্রান্ত দূর্বল মুরগিকে ইনস্ট্যান্ট এনার্জি সরবরাহ করতে খু্বই নির্দিষ্ট পরিমাণে গ্লুকোজ বা চিনি বা গুঁড় দেয়া হয়৷ সাধারণত খাওয়ার পানিতে প্রতি লিটারের সাথে ৫-১০ গ্রাম চিনি/গুঁড় দেয়া হয়। অনেকসময় এই একই পরিমাণে চিনির পানি খাওয়ানো হয় Depressed Growth এর বার্ডের ওজন বৃদ্ধির জন্য৷
এবার আসি সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যায় এবং এই চিনি কই যায় ব্রয়লারের শরীরে সেটি বুঝার চেষ্টা করি। আমি খুব সরল ভাষায় সহজভাবে চিনির মেটাবলিজম বলে দিচ্ছি। টেবিল সুগার বা প্রচলিত চিনি মূলত গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজের সমন্বয়। চিনি পরিপাকতন্ত্রে গিয়ে এনজাইমের সাহায্যে ভেঙ্গে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজে পরিণত হবে। গ্লুকোজ ইনটেস্টাইন হতে শোষিত হবে এবং চলে যাবে ব্লাড স্ট্রিমে। ব্লাড স্ট্রিমে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে প্যানক্রিয়াস হতে ইনসুলিন নামক হরমোন সিক্রেশন শুরু হবে। ইনসুলিনের কাজ হচ্ছে রক্তের এই গ্লুকোজকে শরীরের কোষগুলোতে পাঠিয়ে দেয়া। যদি ইনসুলিন কম থাকে বা রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায় তাহলে রক্তে গ্লুকোজ বাড়লেও শরীরের কোষ তা নিতে পারে না। ফলে শরীর শুকায় যায় এবং রক্তের অতিরিক্ত গ্লুকোজ প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে যায়। এটাকেই মূলত ডায়াবেটিস বলা হয়। যদিও আমরা মানুষের ডায়াবেটিস সম্পর্কে পরবর্তীতে বলবো। আপাতত মুরগির শরীরের এই ব্লাড-গ্লুকোজের পরিণতি জানবো। এই গ্লুকোজ রক্ত হতে কোষে চলে গেলে সেখানে বার্ণ হবে এবং ইনস্ট্যান্ট এনার্জি সাপ্লাই দেবে৷ ধরে নিলাম যদি মুরগি অতিরিক্ত চিনি খেয়ে নেয় তাহলে কি হবে?
এই অতিরিক্ত গ্লুকোজ তখন দুই পরিণতি পেতে পারে।
১. গ্লাইকোজেন হিসেবে লিভার ও স্কেলিটাল মাসলে (মাংসে) জমা হবে।
২. অথবা ফ্যাট বা চর্বিতে পরিণত হবে।
ফ্রুক্টোজের পরিণতি একটু ভিন্ন। এটি ব্লাড থেকে লিভারে যাবে এবং লিভারই নির্ধারণ করবে এটিকে গ্লুকোজে নাকি চর্বিতে কনভার্ট করবে। অর্থাৎ অতিরিক্ত ফ্রুক্টোজেরও শেষ পরিণতি হিসেবে হয় গ্লাইকোজেন বা চর্বিতে পরিণত হবে।
একজন নিয়মিত পোল্ট্রি কনসালটেন্ট হিসেবে ভালভাবেই জানি চিনি নিয়ে খামারিদের নানান রকম সংস্কার রয়েছে। তারা গরমে চিনি খাওয়ায় না হিট স্ট্রেসের ভয়ে আর শীতেও চিনি এভয়েড করে তাদের অমূলক চিন্তার কারণে। তারা মনে করে চিনি খাওয়ালে মুরগির ঠান্ডা লেগে যাবে। একারণে চিনি যতটুকু ব্যবহার করা হয় তা অবশ্যই রিকমেন্ডেড ডোজে।
বাদ দিন, ধরুন মুরগিকে বস্তার পর বস্তা চিনি এনে দেধারসে খাওয়ানো হচ্ছে এবং মুরগি তা হজমও করে টিকে আছে। অর্থাৎ লিভার ও মাংসে গ্লাইকোজেন জমা করতেছে অথবা শরীরে ফ্যাট ডিপোজিশন হচ্ছে। এখন সবথেকে অমূলক বিষয় হলো এই জমাকৃত গ্লাইকোজেন বা ফ্যাট ভক্ষণ করে ডায়াবেটিস ফাঁদানোর মতো গুরুতর অভিযোগ আরোপ করা।
বার্ডকে স্লটার বা জবাইয়ের আগে সাধারণত এগুলোকে খামার থেকে সরিয়ে পরিবহন করে বাজারজাত করা হয়৷ খামার থেকে মুরগি ধরার সময় "ক্যাচিং" এর একটা বিশাল ধকল পড়ে। তার উপর রয়েছে পরিবহনের ধকল। গ্লাইকোজেনের ধর্মই হলো ধকল পড়লে ভেঙ্গে গ্লুকোজে পরিণত হয়ে রক্তে চলে আসে। এই ক্যাচিং ও ট্রান্সপোর্টেশন ধকলে জমাকৃত গ্লাইকোজেন খুব সহজেই ব্রেক ডাউন হয়ে শরীরের ধকল প্রতিরোধে ব্যায় হয়। বাকি যেটুকু রক্তে গ্লুকোজ হিসেবে থাকে তা জবাইয়ের সময় রক্তের সাথে বের হয়ে যায়।
এটাও বাদ দিন, ধরলাম কোন ধকল ছাড়াই ফার্ম থেকে মুরগিকে জবাই করে রান্না করলেন। তবুও এই গ্লাইকোজেন আপনার শরীরে যাবে না। কারণ মীট টেকনোলজির বিশেষ জ্ঞান আমাদের জানাচ্ছে জবাই করার পর মাংসের জমাকৃত গ্লাইকোজেন কনভার্ট হয়ে ল্যাকটিক এসিডে পরিণত হয়। এই ল্যাকটিক এসিডের কারণেই জবাইকৃত মৃত প্রাণীর মাংস নরম, সুস্বাদু ও ভক্ষন উপযোগী থাকে।
গ্লাইকোজেনের বিষয়টি যতটা সূক্ষ, ফ্যাটের বিষয়টি কিন্তু তা নয়। কারণ মাংসের অতিরিক্ত চর্বিতো খালি চোখেই দেখতে পারবেন। আপনারা সবাই স্বীকার করবেন রেড মীট ও ডিম পাড়া মুরগির তুলনায় ব্রয়লারের ফ্যাট এমনিতেই অনেক কম। কারণ এর মেটাবলিজম রেট অনেক বেশি যার কারণে অল্প সময়ে এতো ওজনের মাংস উৎপাদনে সক্ষম। তবুও ধরলাম ফ্যাটের গুদামসহ ব্রয়লার আপনি খেয়ে ফেললেন। এই অযাচিত চর্বি ভক্ষণ যে আপনার শরীরে অনেক বিপদ ডেকে আনবে তা ঠিক। কিন্তু ফ্যাট বা চর্বি সরাসরি রক্তের গ্লুকোজ বিপদসীমায় নিয়ে যাবে এমন কোন প্রমাণ চিকিৎসা বিজ্ঞানে নেই। ফ্যাট জাতীয় খাবার যদি অনেক অনেক বেশি পরিমাণে নিয়মিত খান তাহলে আপনার ইনসুলিন রেজিস্টেন্সি হতে পারে৷ সেই পরিমাণ ফ্যাট একা ব্রয়লার মাংসের পক্ষে যোগান দেয়া কখনোই সম্ভব নয়।
কাজেই পরিশেষে বলতে হচ্ছে, ব্রয়লারকে চিনির ফানি খাওয়ানোর কারণে মানুষের ডায়াবেটিস হবার গল্পটি মোটেই বাস্তবতা ও বিজ্ঞানসম্মত নয়। এধরনের গল্প বলে আমাদের বেকারত্ব ও অভাবের দেশে সোয়া কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে যে পোল্ট্রি শিল্পের মাধ্যমে, যে পোল্ট্রি শিল্পের কারণে গরীব মানুষ মাংস কিনে খেতে পারতেছে, সেই পোল্ট্রি শিল্পকে শূলে চড়ানোর পায়তারা করা কখনোই একজন বিবেকবান শিক্ষকের কাজ হতে পারে না।
যা মুখে আসলো বলে দিলেন? একবার এর কনসিকুয়েন্স অনুধাবন করার মতো দেশপ্রেমের পরিচয় দিন প্লিজ।
লেখকঃ
ডাঃ মোঃ তৌহিদুর রহমান
ডিভিএম, এমএস (পোল্ট্রি সাইন্স)

No comments

Powered by Blogger.