ব্রয়লার প্রাণিজ আমিষের একটি নিরাপদ উৎস। ব্রয়লারের শারীরবৃত্ত, জেনেটিক ইতিহাস, খাদ্য, পালনপদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা।
#ব্রয়লার_একটি_নিরাপদ_প্রাণিজ_আমিষ
ডা. মো. মুনিরুজ্জামান
পৃথিবীর বয়স বাড়ার সাথে সাথে দিনে দিনে বেড়েই চলছে মানুষ। আগত অনাগত মানব প্রজাতির পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা, নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানীরা। যার ফলে উৎপন্ন করা সম্ভব হয়েছে উচ্চ ফলনশীল কৃষি ফসল। প্রাণিজ আমিষ উৎপাদনে ক্ষেত্রে মিলেছে সফলতা। জাত উন্নয়নের মাধ্যমে মাছ মাংস দুধ ডিম উৎপাদনও বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। আর এসবের পিছনে রয়েছে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর বড় রকমের অবদান। আমাদের দেশের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়া, ইঞ্জিনিয়ারিং এ ক্যারিয়ার গড়া অনেক সম্মানের এবং সমাজে গ্রহণযোগ্য হলেও জিন প্রযুক্তির পক্ষ থেকে ফলাফল আমরা সহজে গ্রহণ করিনা।
সেদিন বাজারে গেলাম, মধ্য বয়স্কা একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সাথে গল্প করছেন “ আরে ভাই কোন কিছু খেয়ে ঠিকমতো বাঁচা যাবে না বরং মরতে হবে। যেভাবে সব কিছু হাইব্রিড হচ্ছে তাতে তো মানুষও হাইব্রিড হচ্ছে। আমি হেসে বললাম, চাচা কি বলেন মানুষও হাইব্রিড হচ্ছে? তিনি বলতে শুরু বললেন, “এই যে আমরা এই যে আমরা ব্রয়লার খাচ্ছি, তাতো তৈরি হয় হরমোনের এন্টিবায়োটিক দিয়ে না হলে এত সহজে কি বড় হয় অল্প দিনে? তেলাপিয়া মাছ কৈ মাছ সহ সব মাছ হাইব্রিড পত্রিকায় এসেছে এগুলি খেলে ক্যান্সার হয়। কারণ সবইতো হরমোনের কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি।
চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম চাচার নিজের চোখে কি কোনদিন দেখেছেন। না দেখিনি সবাই বলে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়, ফেসবুক না কি ওটাতেতো সব খবর পাওয়া যায়।
বাজারের ঐ চাচার মত সমাজের অনেকের আজ একই অবস্থা। কিছু লিখলেই যেমন সংবাদ হয়ে যায়, আর গুজব মার্কা খবর গুলা বাতাসের আগেও দৌড়ায়। যার জন্য কিন্তু আমরা অতি সচেতন মানুষেরাই দায়ী।
ফলে ফরমালিন মিশাবো আমরা, ক্যান্সার হলে দোষটাতো তখন ফলের। আর খবর হবে” অমুক ফল খেলে তমুক ক্যান্সার হয়”।
কোনটা মানবে কোনটা মানবে সে বিচার পাঠকের। এখন আসি মূল কথায়। প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা দূর করে সঠিক তথ্য জানার লক্ষে আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
ব্রয়লার কি?
পোল্ট্রি পালন করে মাংস ও ডিম মানুষের খাদ্যতালিকায় যুক্ত হবার খুব বেশি দিনের হবে না। ১৯০০ সালের দিকে কেবল অভিজাত মানুষেরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুরগীর মাংস ও ডিম খেতেন। এরপর ক্ষুদ্র আকারে (সর্বোচ-৪০০) পারিবারিকভাবে মুরগীর লালনপালন শুরু হয়। তখন একটি মুরগী ডিম দিতো বছরে ৮০-১৫০ টা মাত্র। কিন্তু বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে পালন করা মুরগী ২৫০ এর অধিক ডিম দিয়ে থাকে। মুলত পঞ্চাশের দশক থকে মুরগীর মাংসের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। যা ধীরে ধীরে সব শ্রেণীর মানুষের জন্য সহজলভ্য বিজ্ঞানের অবদানে। বাণিজ্যিক ভাবে পালিত মুরগী সাধারণত লেয়ার মুরগী ( শুধু ডিম উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়) এবং ব্রয়লার মুরগী ( যা শুধু মাংস উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়) নামে পরিচিত।
ব্রয়লার হচ্ছে পোল্ট্রির এমন একটি জাত যা অল্প দিনে বৃদ্ধি পায় এবং খাবার উপযোগী । মাংস উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয় বলে এদের ব্রয়লার বলা হয়, যেমন ব্রয়লার মুরগি, ব্রয়লার হাঁস, ব্রয়লার কোয়েল ইত্যাদি। জীন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক ব্রয়লারের (মুরগির) যে ক’টি জাত উদ্ভাবিত হয়েছে তাদের বেশির ভাগ ৪ সপ্তাহ থেকে ৭ সপ্তাহের মধ্যে খাবার উপযোগী হয়।
ব্রয়লারের বায়োলোজি:
আধুনিক বাণিজ্যিক ব্রয়লার, উদাহরণস্বরূপ, কর্ণিশ ক্রস এবং কর্ণিশ-রকস কৃত্রিমভাবে নির্বাচন করে তাদের মাঝে প্রজনন ঘটিয়ে বড় আকারের, দক্ষ মাংস উত্পাদনের জাত তৈরি করা হয়েছে। এদের খুব দ্রুত বৃদ্ধির হার, উচ্চ ফিড রূপান্তর অনুপাত (Food Conversion Ratio=FCR, যা খাদ্যকে শক্তি তথা মাংসে রূপান্তর অনুপাত হিসেবে ধরা যায়), এবং কম পরিশ্রমী হওয়ার জন্য সুপরিচিত। আধুনিক বাণিজ্যিক ব্রয়লারগুলি ৩৫ থেকে ৪৯ দিনের মধ্যে প্রায় ২ কেজি ওজনে পৌঁছাতে সক্ষম। ফলস্বরূপ, মাংসের জন্য ব্রয়লারদের আচরণ এবং শারীরবৃত্ত বিজ্ঞানগুলি (Physiology) প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে অপূর্ণ (immature) পাখির মতো। অপর দিকে ছেড়ে পালন করা মুরগীগুলি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে আর খাবার উপযোগী হতে বেশ সময় লাগে ।
সাধারণত ব্রয়লার সাদা পালক এবং হলুদ ত্বকের হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক জেনেটিক বিশ্লেষণটি প্রকাশ করেছে যে, হলুদ ত্বকের জিনটি ব্রয়লারের মাংস উৎপাদনে সহায়ক হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। আধুনিক ক্রসগুলি মাংসের উৎপাদনের পক্ষেও বেশ উপযুক্ত। কারণ তাদের সাধারণত লোম কম যা এরকম একটি জাতের জন্য কাঙ্ক্ষিত। ইতিপূর্বে শুধু মোরগ ব্রয়লার হিসেবে পালন করা হত কিন্তু বর্তমানে মোরগ এবং মুরগী উভয় তাদের মাংসের জন্য লালনপালন করা হয়।
ব্রয়লারের জীবন চক্র:
গ্রাম-গঞ্জ কিংবা শহর সব জায়গায় ব্রয়লার মুরগী নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারণা আছে। তাই আসুন ব্রয়লারের জীবন চক্র সম্পর্কে জানি।
ব্রয়লারের বাচ্চা: ব্রয়লারে বাচ্চা উৎপাদন হয় ব্রয়লারের প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য বহনকারী বাবা-মা ব্রয়লারের ডিম থেকে। ব্রয়লারের ডিম থেকে হ্যাচারির মাধ্যমে বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। জেনে রাখা ভালো ব্রয়লারের ডিম খাবার জন্য ব্যবহার করা হয় না, তা থেকে শুধু মাংসের জন্য ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। আর যা আমরা বাজারে পাই তা লেয়ার মুরগীর ডিম বা টেবিল এগ নামে পরিচিত।
ব্রয়লার লালনপালন:
আদর্শ পদ্ধতি:
সুস্থ বচ্চা খামারে নিয়ে এসে তার জন্য ব্রুডিং (তাপ) এর ব্যবস্থা করা।
নিয়মিত সুষম খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ।
প্রয়োজনীয় টিকা প্রদান।
অসুস্থ হলে অসুস্থ মুরগী আলাদাকরণ এবং রেজি. ভেটেরিনারি ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা প্রদান।
অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা হলে তার প্রত্যাহার কাল মেনে বাজারজাতকরন।
প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান: অন্যান্য প্রাণী ও মানুষের মতই।
শর্করা
আমিষ
চর্বি
ভিটামিন ও মিনারেল (১৩ টি ভিটামিন, ১৩-১৬ টি জৈব উপাদান, ১৩ টি এমাইনো এসিড ১টি অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড।
পানি।
খাদ্য উপকরণ:
দানাদার খাবার (গম, ভুট্টা, চালের কুড়া বিভিন্ন ডাল ইত্যাদি)
প্রাণীজ আমিষ (মাছের গুড়া, হাড়ের গুড়া প্রভৃতি)
উদ্ভিজ আমিষ ( সয়াবিন, সরিষা ইত্যাদি)
সরবরাহকৃত ভিটামিন-মিনারেল (লবণ, চুন ইত্যাদি)।
ব্রয়লার মাংসের পুষ্টিগুন:
প্রতি ১০০ গ্রাম মুরগিতে প্রাপ্ত উপাদান হচ্ছে:
আর্দ্রতা বা জলীয় ভাগ: ৬৫ গ্রাম,
শক্তি: ২১৫ কিলো ক্যালরি,
প্রোটিন: ১৮ গ্রাম,
ফ্যাট: ১৫ গ্রাম,
স্যাচুরেটেড ফ্যাট: ৪ গ্রাম,
কোলেস্টেরল: ৭৫ মি.গ্রা.,
ক্যালসিয়াম: ১১ মি.গ্রা.,
আয়রন: ০.৯ মি.গ্রা.
ম্যাগনেশিয়াম: ২০ মি.গ্রা.,
ফসফরাস: ১৪৭ মি.গ্রা.,
পটাশিয়াম: ১৮৯ মি.গ্রা.,
সোডিয়াম: ৭০ মি.গ্রা.
জিংক: ১.৩ মি.গ্রা. এবং বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন।
(তথ্যসুত্র: United States Department of Agriculture (USDA)
কিছু বিভ্রান্তি ও তার সমাধান:
ব্রয়লার খেলে ক্যানসার হবার সম্ভাবনা!
একটি গবেষণায় দেখা গেছে পোল্ট্রিকে ক্রোমিয়াম যুক্ত খাবার খাওয়ালে তা মাংসে বিদ্যমান থাকে যা শরীরে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ট্যানারি বর্জ (যাতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি ক্রোমিয়াম পাওয়া যায় ) প্রোটিন উৎস হিসেবে ব্যবহার করে পোল্ট্রির খাবার উৎপাদনের চেষ্টা করে। তা বর্তমান সরকার সফলতার সাথে নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম হয়। আর নিরাপদ পোল্ট্রি খাদ্য সরবরাকৃত পোল্ট্রির মাংস অন্যান্য খাদ্যের মতই নিরাপদ।
পোল্ট্রি মাংসে ব্যাকটেরিয়া!
প্রকৃত পক্ষে আমরা অনুজীব দিয়ে ঘেরা। প্রতিটি খাবারে অনুজীবের ছড়াছড়ি। শুধু মুরগীর মাংস নয়, মাছ, দুধ, ডিম অন্যান্য প্রাণীর মাংস থেকে শুরু করে ফলমূল এবং কৃষিজ ফল ফসলের অনুজীবীয় পরীক্ষায় জীবানু পাওয়া যায়। আর যা দুর হয় উত্তম রূপে ধোয়া এবং রান্নার মাধ্যমে। আমরাতো আর কাচা মাংস খাই না। তাই ভালো ভাবে রান্না করে নিশ্চিন্তে খেতে পারেন মুরগীর মাংস ও তার বিভিন্ন রেসিপি।
ব্রয়লার উৎপাদনে হরমনের ব্যবহার!
এটি সম্পূর্ণরূপে একটি গুজব। যিনি আপনাকে বলবেন তাকে যদি জিজ্ঞেস করেন তিনি হয়তো যুক্তি দেখাবেন উনি শুনেছেন অথবা পাল্টা প্রশ্ন করে আপনাকে থামাতে চাইবেন তা না হলে ২৮ দিনে বড় হয় কি করে? যার উত্তর এখন আপনার জানা। জিনগত বৈশিষ্ঠের উন্নয়নের মাধমে তা সম্ভব হয়েছে। যে ভাবে সম্ভব হয়েছে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে, ডিম উৎপাদ বৃদ্ধিতে, মাছের বৃদ্ধিতে এবং ফসলের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনের।
ব্রয়লারের মাংস খেলে মানুষ ও ব্রয়লারের মত অলস হয়!
বিষয় টি হাস্যকর! মুরগীর মাংস না খেয়ে অত্যধিক কর্মঠ হয়েছেন এমন কোন গবেষণা বা প্রমাণ যেমন কেউ দেখাতে পারবে না। আর কেবল মুরগীর মাংস খাওয়ার কারণে অলস হয়েছেন এটা ভিত্তিহীন। কারণ দ্রুত বৃদ্ধির জন্য দায়ী জিনতো দুরের কথা অন্যকোনো জিন মানুষের শরীরে খাবারের মাধ্যমে প্রবেশ করেনা।
দ্রুত বৃদ্ধিতে অ্যান্টিবায়োটিক!
অ্যান্টিবায়োটিকের এমন কোন গুণ নেই যা ব্রয়লারের বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। তবে এক সময় খাবারের সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হত। যা পরবর্তিতে নিষিদ্ধ করা হলেও আমাদের দেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশ গুলিতে ব্যবহার হয়ে আসছিল। তবে বর্তমানে এর ব্যবহার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। যাতে পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয় এ লক্ষ্যে আমাদের দেশের প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর, এফএও (FAO) বাংলাদেশ ও ভেটেরিনারি ডাক্তারগণ নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। খামারিদের করনণীয়:
বিনা প্রয়োজনে এবং রেজি. ভেটেরিনারি ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাবহার না করা।
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পর এর প্রত্যাহার কাল মেনে চলা।
খামারি ভাই এবং যারা পোল্ট্রি শিল্পের সাথে জড়িত আছেন তাদের প্রতি আহ্বান, আসুন নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে সোচ্চার হয়ে সুস্থ মেধাবী জাতি গঠনে অবদান রাখি।
ক্রেতা ও ভোক্তা ভাইদের প্রতি আহ্বান গুজবে কান না দিয়ে সঠিক তথ্য জানি, নিজে সচেতন হয়ে অপরকে সচেতন করি। আর সকল প্রকার ভীতি এড়িয়ে নিঃসন্দেহে ব্রয়লার খেতে পারেন। প্রয়োজনে সুযোগ থাকলে আপনিও পালন করে দেখতে পারেন।
আজ এ পর্যন্তই, প্রিয় পাঠক ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।
লেখক পরিচিতি
ডা. মো. মুনিরুজ্জামান
ডিভিএম, এমএস ইন পাবলিক হেলথ এন্ড ফুড হাইজিন
জেনারেল প্রাক্টিশনার
ভেটস কেয়ার এন্ড পোল্ট্রি সোলিওশন দিনাজপুর – ৫২০০
মোবাইল: ০১৭৩২০৫৫৭১৮
No comments